July 16, 2025, 7:21 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক অদক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতির বিষয়টি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ গণিত ও ইংরেজিতে আশানুরূপ পারদর্শিতা অর্জন করতে পারছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুর্বলতার সূচনা হয় প্রাথমিক স্তরেই, যেখানে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি গড়ে ওঠে।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকের পাঠদানে দুর্বলতা ও বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার অভাব দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। ওয়েভ ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ১৩.৬২% শিক্ষার্থী এক অংকের সংখ্যা শনাক্ত করতে পারে না। একই শ্রেণিতে ৭৯.৫৩% শিক্ষার্থী দুটি বিয়োগ ও ৯৬.৫৪% শিক্ষার্থী দুটি ভাগ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ। ইংরেজি বিষয়েও চিত্র হতাশাজনক—প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির যথাক্রমে ১৬.৭৮% ছেলে এবং ১৫.২২% মেয়ে একটি বর্ণও পড়তে পারে না।
সরকারি প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে একই চিত্র। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০২২ সালের জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, তৃতীয় শ্রেণির মাত্র ৩৯% এবং পঞ্চম শ্রেণির ৩০% শিক্ষার্থী গণিতে শ্রেণিকক্ষ অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই দুর্বলতার পেছনে মূলত রয়েছে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকা এবং পেশাগত প্রস্তুতির ঘাটতি।
জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) ২০২২ সালের গবেষণা ‘Measuring Teachers’ Effectiveness’-এ উঠে আসে, পর্যবেক্ষণ করা শিক্ষককের মধ্যে মাত্র ১৯.১৪% এর ক্লাস পারফরম্যান্স সন্তোষজনক, ৪৪.৩% মোটামুটি সন্তোষজনক এবং ৩৬.৩% একেবারেই সন্তোষজনক নয়। এ গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও পাঠদান কৌশলে সুস্পষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
নেপের আরও দুটি গবেষণাতেও (২০১৯) গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষাদানে শিক্ষকদের অক্ষমতার বিষয়টি উঠে আসে। গণিত বিষয়ে অধিকাংশ শিক্ষকই পাঠদানকে ‘কঠিন’ মনে করেন। ইংরেজি শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁদের উচ্চারণ ও শব্দভাণ্ডারে রয়েছে সীমাবদ্ধতা।
দক্ষ শিক্ষক তৈরির অন্যতম উপায় হলো মানসম্মত প্রশিক্ষণ। বর্তমানে ৬৭টি প্রাথমিক টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধীনে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হলেও ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ২৫% শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণের বাইরে। মোট ৩.৮৪ লাখ শিক্ষকের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ২.৯৭ লাখ।
তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরাও অনেক সময় ক্লাসে সেই জ্ঞান প্রয়োগ করছেন না বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অপর্যাপ্ত মনিটরিং এবং জবাবদিহিতার অভাবে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। তদুপরি, এসব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নিজস্ব জনবল সংকট রয়েছে—১,০৪১টি ইনস্ট্রাক্টর পদের মধ্যে ৩৬০টি শূন্য, এবং বাংলা, গণিত ও ইংরেজির জন্য ২০২৩ সালে তৈরি ৬৭টি করে ইনস্ট্রাক্টর পদের সবকটিই এখনও পূরণ হয়নি।
ঢাকা পিটিআইয়ের সুপারিনটেনডেন্ট মো. কামরুজ্জামান বলেন, “শিক্ষকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—শিক্ষকেরা ক্লাসে সেই প্রশিক্ষণের বাস্তব প্রয়োগ করছেন না। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা এবং দক্ষ শিক্ষকদের পুরস্কৃত ও দুর্বলদের জবাবদিহির আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি।”
প্রাথমিক স্তরেই যদি শিক্ষার্থীরা গণিত ও ইংরেজিতে দুর্বলতা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে, তবে ভবিষ্যতের শিক্ষা অর্জন এবং কর্মজীবন উভয়ই চ্যালেঞ্জপূর্ণ হয়ে উঠবে। শিক্ষকদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এ দুর্বলতা আরও বিস্তৃত হবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো জাতির শিক্ষাগত মান ও সক্ষমতায়।
Leave a Reply